বাংলাদেশের ঢাকা শহরে বিবাহবিচ্ছেদের হার বাড়ছে৷ আর এই বিবাহবিচ্ছেদে নারীরাই এখন এগিয়ে আছেন৷ বিচ্ছেদ কেন বাড়ছে? আর কেনইবা নারীরা এগিয়ে আছেন তা নিয়ে নানা কথা রয়েছে৷ প্রশ্ন উঠছে এটা সচেতনতার ফল না কথিত আধুনিকতার প্রভাব৷
ঢাকায় সদ্য বিচ্ছেদ হওয়া এক নারীর সঙ্গে কথা হলো গত সপ্তাহেই৷ কথা বলে বুঝতে পারলাম বিচ্ছেদটা তিনি নিজেও চাননি৷ কারণ প্রেম করেই তরুণকে তিনি বিয়ে করেন৷ তাঁর মতে, বিয়ের আগের সেই মানুষটি বিয়ের পরে অন্যরকম হয়ে যান৷ সারাক্ষণ সন্দেহ, আগের বন্ধুদের সহ্য না করা, এমনকি গায়ে হাত তুলতেও নাকি পিছপা হন না৷ তাই বিয়েটি এক বছরের বেশি টেকানো যায়নি৷
তার সাফ কথা ‘‘সংসার নামের টর্চার সেলে থাকার চেয়ে বিচ্ছেদ অনেক ভাল৷”
প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিবর্তনের কারণ কি? ইগোকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব? সামাজিক অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে? না কি প্রভাব পড়ছে নানা টিভি সিরিয়ালের? নাকি মুক্ত অন্তর্জালে সবার সাথে ব্যক্তিগত মিথস্ক্রিয়ার অবার সুযোগ?
সাম্প্রতিক প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, তালাক দেয়া পুরুষ ৩০ শতাংশ, আর নারী ৭০ শতাংশ৷
একাধিক পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে মাত্র তিন বছরে ঢাকা শহরে তালাকের পরিমান বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ৷ মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের নারীদের আইনী সহায়তা কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যত অভিযোগ নারীরা তাদের কাছে নিয়ে আসেন তার মধ্যে ৬০ ভাগেরও বেশি সন্তানকে নিজের কাছে রাখার দাবি৷
ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণ ও উত্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১০-২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে তালাকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫২ হাজার। গতবছর এই সংখ্যা ছিল সাড়ে ৬ হাজার। যা ২০১৫ সালে ছিল প্রায় ৯ হাজার। এর আগে ২০১৪ সালে ৮ হাজার ২১৫টি, ২০১৩ সালে ৮ হাজার ২১৪, ২০১২ সালে ৭ হাজার ৯৯৫, ২০১১ সালে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে ৫ হাজার ৩২২ এবং ২০১০ সালে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার। প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০টির মতো বিচ্ছেদের আবেদন জমা হচ্ছে। প্রতিবছরই আগের বছরের তুলনায় বাড়ছে এই সংখ্যা। বর্তমানে রাজধানীতেই নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে ৪৯ হাজার বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন।
স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়া অথবা আভিজাত্যের অহঙ্কারে ভেঙে যাচ্ছে রাজধানীর বহু সাজানো ঘর, জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে সুখের সংসার। ইন্টারনেট, ফেইসবুক মোবাইল ফোনসহ যাবতীয় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। উদ্বুদ্ধ করছে প্রতিবেশী দেশের বিভিন্ন হিন্দি সিরিয়াল, নাটক এবং নানা দেশীয় পর্নোগ্রাফি। এসব কিছুর সহজলভ্যতায় নৈতিক মূল্যবোধ হারাচ্ছে অনেক নারী-পুরুষ। ঘটছে নৈতিক স্খলনও। এতে তারা জড়িয়ে পড়ছে পরকীয়ার মতো গুরুতর সামাজিক অপরাধে।
বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ:
জাতীয় মহিলা পরিষদ নারীদের তালাকের ক্ষেত্রে প্রধানত চারটি কারণকে চিহ্নিত করেছে৷এগুলো হলো: যৌতুক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং স্বামীর পরনারীতে আসক্তি৷
সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর মেহতাব খানমের মতে দুটি কারণে ইদানিং বিবাহ-বিচ্ছেদ বাড়ছে। প্রথমত, মেয়েরা আগের চেয়ে বেশি শিক্ষিত হচ্ছে। তারা এখন অনেক সচেতন। মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য না করে ডিভোর্সের পথ বেছে নিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, মোবাইল কোম্পানিগুলোর নানা অফার, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, ফেসবুক এবং পর্নোগ্রাফির মতো সহজলভ্য উপাদান থেকে আকৃষ্ট হয়ে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা হারাচ্ছেন। ফলে বিয়ের মতো সুদৃঢ় সম্পর্ক এবং নৈতিক বিষয়টি ছিন্ন করতে একটুও দ্বিধা করছেন না।
এছাড়াও সংসারে অশান্তির অন্যতম একটি কারণ মাদক। মাদক গ্রহণের ফলে ছেলেরা বিবেচনাবোধ হারিয়ে ফেলে। ছোটখাটো বিষয়ে রেগে গিয়ে স্ত্রীকে পেটায়। মাদকাসক্ত ব্যক্তি অমানুষে পরিণত হয়। মাদকাসক্ত পুরুষ দ্বারা নারী নির্যাতনের হারটা অনেক বেশি। তবে ইদানীং নারীদেরও মাদকাসক্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে তবে সেই সংখ্যাটা অনেক কম। বিশ্লেষকরা বলেন, স্ত্রীকে নির্যাতনকারী স্বামীদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। আর অন্যদিকে মাদকাসক্ত নারীরা একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক বজায় রাখে।
বিবাহ ও বিচ্ছেদ নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন গবেষণা করছে ১৯৯৫ সাল থেকে। করপোরেশন উত্তর ও দক্ষিণ অংশে বিভক্ত হওয়ার পরও তা জারি আছে। প্রতিবছর জুনে তারা গবেষণা প্রতিবেদন জমা দেয়। তাদের গবেষণা অনুযায়ী, যেসব আবেদন ইতিমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে তার মধ্যে ৮৭ শতাংশ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে পরকীয়ার জের ধরে।
পুরুষরা কেন স্ত্রীকে তালাক দেয় তা নিয়ে এরকম কোন আলাদা গবেষণার কথা জানা নেই৷ তবে স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন এমন কয়েকজন পুরুষের সঙ্গে কথা বলা জানা যায় তারা প্রধানত স্ত্রীর ‘চরিত্র দোষকেই’ কিংবা অতিরিক্ত উচ্চাভিলাসকে দায়ী করতে চান৷
অনেক নারীই নিজের সংসারে শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হন। নীরবে নির্যাতন সহ্য করতে করতে এক সময় সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি হয়। সংসারের এই বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় অনেক নারীই জড়িয়ে যান পরকীয়ার নিষিদ্ধ সম্পর্কে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকার কারণে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে একঘেয়েমিতা চলে আসে।তখন নতুন একজনের সঙ্গ পেলে ভালোলাগার অনুভূতি তৈরি হয়।
আর বিয়ে বা সাংসারিক জীবনে কোনোভাবেই যৌনতাকে বাদ দেয়া যাবে না। বরং যৌনতাকে ঘিরেই দাম্পত্য জীবনে গতি আসে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনো সংসারে অভাব-অনটন থাকলে যতটা অশান্তি হবে তার চেয়ে ভয়াবহ অশান্তি হবে যদি কোনো দম্পতির যৌন জীবন সুখের না হয়। পরকীয়া বা বিবাহ বিচ্ছেদের সবচেয়ে আদিম কারণ শারীরিক চাহিদা অপূর্ণ থাকা।
এ থেকে একটি বিষয় এখন স্পষ্ট যে ‘পরনারী’ বা ‘পরপুরুষে’ আসক্তির অভিযোগ বাড়ছে৷ এজন্য কেউ কেউ পাশের একটি দেশের হিন্দি এবং বাংলা টেলিভিশন সিরিয়ালকে দায়ী করতে চাইছেন৷ তাদের কথা হল এইসব সিরিয়ালের প্রধান উপজীব্যই হল ‘পরকীয়া প্রেম৷’
এছাড়া নানা কারণে কিছু নারী-পুরষ উভয়ই বিয়ের পর বিবাহ বহির্ভূত রোমান্সে বা যৌন সম্পর্কে জড়াচ্ছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷তবে সবচেয়ে বড় কারণ হল বিশ্বাসহীনতা ৷ নানা কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাসহীনতা বাড়ছে৷ এখন দু’জনই কাজ করছেন, বাইরে যাচ্ছেন৷ তাদের সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতি জনের সঙ্গে মিশছেন, ঘুরছেন বা কথা বলছেন৷ শুধু তাই নয়৷ মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এই যোগাযোগ সার্বক্ষণিক যোগযোগে পরিণত হয়৷
আর এখানে স্বচ্ছতা না থাকলেই ঘটছে বিপর্যয়!!!